হসপিটালিটি খাতে নীরব সংকট

আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রমের ওপর ঢালাও নিষেধাজ্ঞা কেন অর্থনৈতিকভাবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হতে পারে

হসপিটালিটি খাতে নীরব সংকট
রাজউকের অননুমোদিত বাণিজ্যিক কার্যকলাপ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি (তারিখ: ০৬/১০/২০২৫)

লেখকঃ মোঃ গোলাম মোস্তফা (টুকু) 
এডিটর-ইন-চিফ ও চেয়ারম্যান


সূত্র: অননুমোদিত বাণিজ্যিক কার্যক্রম বিষয়ক রাজউকের বিজ্ঞপ্তি (তারিখ: ০৬/১০/২০২৫)


১. সারসংক্ষেপ (Executive Summary)


গত ৬ অক্টোবর ২০২৫, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এক জরুরি নির্দেশনার মাধ্যমে গুলশান, বনানী, বারিধারা এবং উত্তরার মতো আবাসিক এলাকাগুলোতে সব ধরণের "অননুমোদিত বাণিজ্যিক কার্যক্রম" ৩০ দিনের মধ্যে বন্ধ ও অপসারণের নির্দেশ দিয়েছে। যদিও এই নোটিশের আপাত লক্ষ্য গেস্ট হাউস, রেস্তোরাঁ এবং হোটেলগুলো সরিয়ে আবাসিক এলাকার পবিত্রতা ফিরিয়ে আনা, তবুও গভীর বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, এই "পোড়ামাটি নীতি" (Scorched earth policy) বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধমনীকে পঙ্গু করে দিতে পারে।
এই প্রতিবেদনে যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে যে, নিয়ম মেনে চলা বুটিক হোটেলগুলো নির্বিচারে বন্ধ করে দিলে তা জাতীয় জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা একটি খাতকে অস্থিতিশীল করবে, দক্ষ জনশক্তির সংকট বাড়াবে এবং বৈশ্বিক নগর পরিকল্পনার আধুনিক মানদণ্ডের সাথে সাংঘর্ষিক হবে।


২. অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট: সংকটাপন্ন শিল্পকে আরও বিপদে ফেলা


এই নোটিশ জারির সময়টি এর চেয়ে খারাপ হতে পারত না। হসপিটালিটি খাত বর্তমানে আমাদের সেবা অর্থনীতির মেরুদণ্ড, অথচ এটি এখনও ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, পর্যটন ও হসপিটালিটি খাত বাংলাদেশের জিডিপিতে প্রায় ৩% অবদান রাখে, যা আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও নেপালের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বুকিং বাতিলের ধাক্কা সামলে এই খাতটি যখন ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম করছে, ঠিক তখনই এই আঘাত এল।
• একটি "ভঙ্গুর" পুনরুদ্ধার: ২০২৪ সালে বিদেশি পর্যটকদের থেকে আয় আগের বছরের ৪৫৩ মিলিয়ন ডলার থেকে কমে ৪৪০ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। বিদেশি এনজিও কর্মী, মধ্যম সারির কূটনীতিক এবং ব্যবসায়ীরা—যারা প্রায়ই বড় চেইন হোটেলের চেয়ে গুলশানের বুটিক হোটেলের আতিথেয়তা ও ঘরোয়া পরিবেশ পছন্দ করেন—তাদের সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর এই ঢালাও নিষেধাজ্ঞা আয়ের এই অংককে আরও নিচে নামিয়ে দেবে।
• মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্ট (The Multiplier Effect): বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) "হোটেল ও রেস্তোরাঁ জরিপ ২০২০" অনুযায়ী, এই খাতের গ্রস ভ্যালু অ্যাডেড (Gross Value Added) ২০০৯-১০ সালের ১১৯ বিলিয়ন টাকা থেকে বেড়ে ২০১৯-২০ সালে ৮৭৯ বিলিয়ন টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই ব্যবসাগুলো বন্ধ করা মানে এক দশকের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে এক নিমিষে মুছে ফেলা।

৩. "ফাইভ-স্টার ভ্রান্ত ধারণা" বনাম বাস্তব বাজার চিত্র


একটি প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে ছোট হোটেলগুলো বন্ধ করে দিলে সেই রাজস্ব ফাইভ-স্টার হোটেলগুলোতে চলে যাবে। তবে পরিসংখ্যান ও উপাত্ত ভিন্ন কথা বলে।
• মধ্যবিত্তের সংকট (The Missing Middle): ঢাকার ফাইভ-স্টার হোটেলগুলোর খরচ (প্রায়ই প্রতি রাতে ২০০ ডলারের বেশি) অধিকাংশ ভ্রমণকারীর সাধ্যের বাইরে। আবাসিক এলাকার বুটিক হোটেলগুলো "মিড-মার্কেট" বা মধ্যম আয়ের (৫০-১২০ ডলার) ভ্রমণকারীদের চাহিদা পূরণ করে। এগুলো বাজেট-সচেতন ব্যবসায়ীদের রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে উন্নতমানের সেবা প্রদান করে।
• বিনিয়োগ বাস্তবতা: স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা এই ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো পছন্দ করেন কারণ এগুলো আর্থিকভাবে টেকসই। ফাইভ-স্টার প্রপার্টির দীর্ঘমেয়াদী এবং বিশাল মূলধনের রিটার্নের তুলনায় মধ্যম মানের হোটেলগুলো সাধারণত ১২-১৫% আরওআই (ROI) প্রদান করে। রাজউক এগুলো নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে হসপিটালিটি মার্কেটের সবচেয়ে দক্ষ অংশটিকেই শাস্তি দিচ্ছে।
• রাজস্ব হারানো: এই ৩-স্টার এবং বুটিক অপশনগুলো সরিয়ে নিলে ভ্রমণকারীরা ফাইভ-স্টারে "আপগ্রেড" করবেন না; বরং তারা তাদের সফরের মেয়াদ কমিয়ে দেবেন অথবা ভাড়ার বাসায় (Rental options) থাকবেন, যা দেশের অর্থনীতিতে খুব কম অবদান রাখে। আরও আশঙ্কার বিষয় হলো, তারা ব্যাংকক বা কাঠমান্ডুর মতো বিকল্প গন্তব্য বেছে নিতে পারেন, যেখানে আবাসনের বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্য রয়েছে।

৪. বৈশ্বিক নগর পরিকল্পনা: আমরা কি পেছনের দিকে হাঁটছি?


রাজউকের "আবাসিক" বনাম "বাণিজ্যিক" এর কঠোর বিভাজন বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের একটি সেকেলে ধারণা। আধুনিক বিশ্ব এখন "মিশ্র-ব্যবহার জোনিং" (Mixed-Use Zoning)-এর দিকে ঝুঁকছে।
বিশ্বের কিছু উন্নত শহরের দিকে তাকালে আমরা এর প্রমাণ পাই:
• প্যারিস ও লন্ডন: প্যারিসের মতো শহরগুলোতে "জেনারেল আরবান" জোনিং ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে বুটিক হোটেলগুলো অ্যাপার্টমেন্টের পাশেই সহাবস্থান করে। এটি একটি প্রাণবন্ত এবং হাঁটার উপযোগী এলাকা তৈরি করে।
• ব্যাংকক: ব্যাংককের ল্যাংসুয়ান এলাকা এর একটি প্রধান উদাহরণ, যেখানে উচ্চমানের আবাসিক ইউনিট এবং হসপিটালিটি ব্যবসা (যেমন কিম্পটন মা-লাই) একে অপরের সাথে মিশে আছে এবং একটি "স্বয়ংসম্পূর্ণ ইকোসিস্টেম" তৈরি করেছে যা সম্পত্তির মূল্য বৃদ্ধি করে।
সিদ্ধান্ত: বিভাজন বা সেগ্রিগেশন রাতে এলাকাগুলোকে "মৃত জোন" (Dead zones) এবং দিনে যানজটের সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, মিশ্র-ব্যবহারের এলাকাগুলো নিরাপত্তা এবং সামাজিক প্রাণচাঞ্চল্যের বৈশ্বিক মানদণ্ড হিসেবে স্বীকৃত।

৫. মানবিক মূল্য: বেকারত্বের ঝুঁকি


হসপিটালিটি খাত একটি বিশাল কর্মসংস্থান ক্ষেত্র। এই নিষেধাজ্ঞা লাখ লাখ মানুষের জীবিকাকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে এবং আমাদের কর্মসংস্থানের হারে, বিশেষ করে দক্ষ কর্মীদের শতাংশে বড় আঘাত হানবে। ধারণা করা হয়, ভ্রমণ ও পর্যটন খাত বাংলাদেশে প্রায় ২৪ লাখ কর্মসংস্থানে সহায়তা করে।
এগুলো কেবল অদক্ষ কাজ নয়; এর মধ্যে রয়েছে হোটেল ম্যানেজার, শেফ, ফ্রন্ট-ডেস্ক অফিসার এবং ইংরেজি জানা কনসিয়াজ কর্মী। বনানী ও গুলশানের বুটিক হোটেলগুলো বন্ধ হলে এই দক্ষ কর্মীরা স্থানীয় বাজারে কাজের সংকটে পড়বেন। এর অনিবার্য ফল হবে দেশান্তর—আমরা আমাদের সেরা প্রশিক্ষিত সেবা পেশাজীবীদের মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার হোটেলগুলোর কাছে হারাবো।
তারা হয়তো রেমিট্যান্স পাঠাবেন, কিন্তু আমরা তাদের দৈনন্দিন শ্রমের মূল্য হারাবো। দশকের পুরোনো নিয়ম চাপিয়ে আমরা তাদের নিজের দেশে কাজ করতে না দিয়ে মূলত অন্য দেশের পর্যটন শিল্প গড়ার জন্য কর্মী তৈরি করছি।

৬. সুপারিশ: বিলুপ্তি নয়, চাই সঠিক প্রবিধান 

বর্তমান রাজউক নোটিশটি ২০১৬ সালের হলি আর্টিজান পরবর্তী উচ্ছেদ অভিযানের ভুলের পুনরাবৃত্তি করছে, যা তাড়াহুড়ো এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার কারণে সমালোচিত হয়েছিল।
আমরা একটি "স্মার্ট কমপ্লায়েন্স" (Smart Compliance) কাঠামোর প্রস্তাব করছি:


১. মানের ভিত্তিতে পার্থক্যকরণ: উচ্চ-নিরাপত্তাসম্পন্ন বুটিক হোটেল এবং অবৈধ স্পাকে এক পাল্লায় মাপা যাবে না। যারা কঠোর অগ্নিনরাপত্তা, স্বাস্থ্যবিধি এবং নিরাপত্তা প্রোটোকল মেনে চলে, তাদের জন্য "ডিপ্লোম্যাটিক জোন হসপিটালিটি লাইসেন্স" চালু করুন।


২. পুরানো প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ সুবিধা (Grandfathering Clause): যেসব প্রতিষ্ঠান ৫ বছরের বেশি সময় ধরে পরিষ্কার ট্যাক্স এবং সেফটি রেকর্ড নিয়ে চলছে, তাদের বিশেষ "বাণিজ্যিক প্রভাব ফি" (Commercial impact fee) দিয়ে সিটি কর্পোরেশনের আওতায় টিকে থাকার সুযোগ দেওয়া হোক।

৩. প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিতকরণ:

পুরো শিল্পকে শাস্তি না দিয়ে এনফোর্সমেন্ট বা প্রয়োগের জোর দিন তাদের ওপর যারা প্রকৃত সমস্যা সৃষ্টি করছে—যাদের ফায়ার এক্সিট নেই, যারা অবৈধ পণ্য বিক্রি করে বা যারা শব্দ দূষণ করে।
"এভিয়েশন অ্যান্ড ট্যুরিজম টাইমস" বাংলাদেশের নিয়ম মেনে চলা, নিরাপদ এবং পেশাদার বুটিক হোটেল মালিকদের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমরা বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার এবং রাজউকের সাথে কাজ করে এই ক্ষতিকারক নীতিটি সংশোধন করার আহ্বান জানাই।